দেশপ্রেম বাংলা প্রবন্ধ রচনা ২০২৩ | written by Composition.
স্বদেশ প্রেম বাংলা প্রবন্ধ রচনা ২০২৩ |
আরো পড়ুন :-
বর্ষণমুখর সন্ধ্যা বাংলা প্রবন্ধ রচনা ২০২৩
ভূমিকা :
নিজের দেশকে ভালােবাসে না এমন কে আছে? নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে ভালােবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম । দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত গুণ। সামাজিক মানুষের দেশের প্রতি গভীর মমত্ববােধই হলাে দেশপ্রেমের উৎস। দেশপ্রেম উজ্জীবিত মানুষের তখন একটাই প্রার্থনা _
‘আমার এই দেশেতেই জন্য যেন, এই দেশেতেই মরি।
দেশপ্রেমের স্বরূপ ও চেতনা :
মা, মাটি ও মানুষকে ভালােবাসার মধ্যেই দেশপ্রেমের মূল সত্য নিহিত । প্রত্যেক মানুষের দেহ | মন বিশ্বাস আদর্শ সবকিছুই স্বদেশের বিভিন্ন উপাদান দ্বারা পুষ্ট । তাই সে দেশের ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি এবং জীবন ও পরিবেশকে ভালােবাসতে শুরু করে । এই ভালােবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম । শুধু মুখে মুখে এই ভালােবাসার কথা বললেই দেশপ্রেম হয় না। চিন্তায়, কথায় ও কাজে দেশের জন্য যে ভালােবাসে প্রকাশ পায় সেটাই প্রকৃত | দেশপ্রেম। ফলে স্বদেশের জন্যে তার যে প্রেম তা কৃতজ্ঞতার, কর্তব্যের এবং দায়িত্বের । বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, স্বদেশপ্রেম যেসব বৈশিষ্ট্য দ্বারা উজ্জ্বল সেগুলাে হলাে- আত্মত্যাগ, বীরত্ব, সরলতা, শর্তহীনতা, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব, কর্তব্য এবং একাত্মবােধ।
দেশপ্রেমের প্রকাশ ও দৃষ্টান্ত :
এই সর্বগ্রাসী দিকটি অ্যাডউইন আর্নল্ডের ভাষায় চমৎকার ফুটে ওঠে : জীবনকে ভালােবাসি সত্য, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মধ্যে কোনাে সংকীর্ণ চিন্তা থাকে না। দশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধিই দেশপ্রেমিকের সর্বক্ষণের চিন্তা। কর্মের বিষয়। দেশের স্বার্থকে তিনি সবকিছুর ঊর্ধের্ব স্থান দিয়ে থাকেন। নিজের অহংকার, মেথা, প্রজ্ঞা ও গৌরব স্বদেশের। জন্য নিবেদন করেন ।
দেশের জন্য নিজেতে অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে দেশের মর্যাদা রক্ষা করেন। দেশ সেবার মানসিক শক্তি যার আছে, তার মধ্যে কোনাে সংকীর্ণতা থাকে না। থাকে না কোনাে প্রকার ভয়-ভীতি। দেশ সেবার পথে পথে সাজানাে হ মৃত্যুর তােরণদ্বার । থাকে পথে পথে বাধাবিপত্তি। মৃত্যুর গর্জন তার কানে বাজে সংগীতের মতাে।
যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ব্রিটিশ-বিরােধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিয়েছে তিতুমীর, প্রীতিলতা । ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেছে ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা শহিদ হয়েছেন, রফিক, বরকত, সালাম, জাব্বার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্ম-বিসর্জিত অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, লক্ষ লক্ষ মা-বােন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অকুতােভয় সৈনিকদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারি ।
দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল। এছাড়া উপমহাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নিজেদের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে দেশপ্রেমের অম্লান স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাছাড়া ইতালির গ্যারিবাল্ডি, রাশিয়ার লেনিন ও স্তালিন, চীনের মাও সেতুঙ, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভিয়েতনামের হাে-চি-মিন, তুরস্কের মােস্তফা কামাল পাশা প্রমুখ ব্যক্তিগণ নিজ নিজ মহিমায় ভাস্বর ।
দেশপ্রেমের উপায় :
পবিত্র ইসলাম ধর্মে ঘােষিত হয়েছে ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। পৃথিবীতে এমন কোনাে ধর্ম নেই, যে ধর্মে দেশকে ভালােবাসার নির্দেশ দেয়া হয় নি । দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মানুষ জীবনে। যেকোনাে সময়ে যেকোনাে স্থান থেকে দেশকে ভালােবাসতে পারে । নিজ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের মধ্যে দেশপ্রেম নিহিত।
যদিও আমরা জন্মের পরেই দেশকে ভালােবাসতে শুরু করি, ছাত্রাবস্থায় জন্মভূমি সম্পর্কে বেশি জ্ঞানার্জন করা হয় বলে দেশের প্রতি মমত্ববােধও তখন জাগ্রত হয় বেশি। এ কারণে ছাত্রজীবন দেশপ্রেমের প্রকৃষ্ট সময়। দেশপ্রেম হৃদয়ে থাকলে দেশের মাটি, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছুই অতি আপন বলে মনে হয় । দেশকে এগিয়ে নেয়ার ছাত্ররাও নানাভাবে দেশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে পারে ।
দেশকে ভালােবাসার জন্যে, দেশের জন্যে, প্রত্যেক মানুষের জন্যে, তা সে ছােটই হােক কি বড়উ হােক- তার কিছু না কিছু করার আছে। বন্যা বা ঝড়-জলােচ্ছ্বাসের সময় দুর্গতদের পাশে এসে দাঁড়ানাে দেশপ্রেমেরে কাজ। দেশের দুর্দিনে দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানাে, এমনকী দেশের মঙ্গল কামনা দেশপ্রেমের কাজ। নিরক্ষরতা কিংবা দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজ যেমন দেশপ্রেমের কাজ, তেমনি কৃষক কৃষি-উৎপাদন বাড়িয়ে, সাহিত্যিক তার সাহিত্যসাধনার মাধ্যমেও দেশের প্রতি ভালােবাসা জ্ঞাপন করতে পারে ।
বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বেগম রােকেয়া, জগদীশচন্দ্র বসু, জয়নুল আবেদীন, মুহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রমুখ মনীষীর নানা অবদানের মধ্যে রয়েছে দেশপ্রেমের পরিচয় । স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলে মানুষকে ভালােবাসতে হবে। নিজের দৈন্যদশাকে তুচ্ছ করতে হবে এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে ।
আর এজন্যই কবি বলেছেন _
‘স্বদেশের উপকারে নেই যার মন
কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন।'
দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম :
স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ । তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে কোনাে বিরােধ থাকতে পারে না। বরং স্বদেশপ্রীতির ভেতর দিয়ে বিশ্বপ্রীতির এক মহৎ উপলব্ধি জাগরণ। স্বদেশ তাে বিশ্বেরই অন্তর্ভুক্ত । স্বদেশপ্রেম যদি বিশ্বমৈত্রী ও আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না । স্বদেশবাসীকে ভালােবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ। বিশ্ববাসীকে ভালােবাসতে শেখে।
দেশপ্রেমের উগ্রতা :
দেশপ্রেম যেখানে মানুষের এক উন্নতিবৃত্তি, যেখানে তা ত্যাগ-তিতিক্ষার মহৎ বৈভবে উদ্ভাসিত, সেখানে তা গৌরবের বস্তু, অহংকারের বিষয়। কিন্তু দেশপ্রেম যেখানে অন্ধ ও উগ্র, সেখানে জাতির জীবনে তা বিপজ্জনক। সেখানে তা ডেকে আনে এক ভয়াবহ সর্বনাশা পরিণতি ।
দেশপ্রেম ও আমাদের কর্তব্য :
পৃথিবীতে বীর, বিপ্লবী, ত্যাগী মহৎ দেশপ্রেমিক মানুষে সংখ্যা কম নয়। দেশে দেশে এই মহৎ দেশপ্রেমিক মানুষেরা ত্যাগের আদর্শ রেখে গেছেন। তারা এই পৃথিবীকে করতে চেয়েছেন সুন্দর, কল্যাণকর, শন্তিময় । কিন্তু । মানুষের এই স্বপ্ন আজো সার্থক হয় নি । যে লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে তারা জীবন উৎসর্গ করেন মানুষ সেই ত্যাগ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনকে আরাে দুঃখময় করে তােলেন। মানুষ জীবন দেয় ঠিকই কিন্তু তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হয় না। আজো পৃথিবীতে হিংসা, দ্বেষ, হানাহানি, অশান্তি দূর হয় না, মানুষের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। তবে কি _
' বীরের
এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা
তার যতাে মূল্য সেকি ধরার ধুলায় হবে হারা ?'
মানুষের
সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণ ছাড়া
এইসব মহৎ আত্মত্যাগ ও জীবন উৎসর্গ
প্রকৃত মর্যাদা পাবে না । আমরা
যদি বীর, বিপ্লবী, ত্যাগী দেশপ্রেমিকদের মর্যাদা দিতে চাই তাহলে তাদের কর্ম ও আদর্শকে মূল্য
দিতে হবে। তাহলেই তাদের জীবনদান, ও দেশপ্রেম সার্থক
হবে । আর এটাই
হচ্ছে দেশপ্রেমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের
শ্রেষ্ঠ উপায় । এটাই হচ্ছে
দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ।
উপসংহার :
দেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ ও অমূল্য সম্পদ। একটি মহৎ গুণ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দেশপ্রেম থাকা উচিত। দেশপ্রেমের মূল লক্ষ্য মানুষকে ভালােবাসা। দেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই অংশ বিশেষ। ব্যক্তিস্বার্থকে ত্যাগ করে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে ভালােবাসাটা দেশপ্রেম। আর দেশের ঊর্ধ্বে সমগ্র পৃথিবীকে ভালােবাসাই বিশ্বপ্রেম। সুতরাং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কিছু না কিছু অবদান রাখা প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।