বাংলা প্রবন্ধ রচনা : শৃঙ্খলাবোধ - by Composition
শৃঙ্খলাবোধ
বাংলা প্রবন্ধ
রচনা |
আরো পড়ুন :-
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রতিকার রচনা ২০২৩
ভূমিকা :
জগৎ
শৃঙ্খলার জালে বাঁধা, নিয়মের জালে আটকানো। অণু থেকে অট্টালিকা পর্যন্ত, এই মহাবিশ্বে যা
কিছু দৃশমান এবং অদৃশ্য সবকিছুই একটি বিশেষ সজ্জায় সাজানো, একটি বিশেষ শৃঙ্খলে বাঁধা। এই সজ্জা বা
শৃঙ্খলাই নিয়ম । এ বিশ্বলঙ্গ
নিয়মের অধীন । সবকিছুতেই নিয়ম
মেনে চলতে হয় । এই যে
কথা বলছি, লেখা পড়ছি-এখানেও রয়েছে নিয়মের শৃঙ্খল, ধ্বনির শৃঙ্খলা । দু' চোখ
ভরে যা দেখছি তাতেও
নিয়মের শৃঙ্খলা । নিয়ম বা
শৃঙ্খলার বাইরে যাওয়ার আমাদের কোনো উপায় নেই । যেখানে নিয়ম
নেই সেখানেই বিশৃঙ্খলা । জন্ম থেকে
শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত এই পৃথিবীর সব
কাজে- খাদ্য, বস্ত্র, অনু রাসস্থান, চিকিৎসা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয় । সুতরাং নিয়মানুবর্তিতা
মানবজীবনের একটি অনিবার্য আবশ্যকতা।
শৃঙ্খলাবোধের বৈশিষ্ট্য :
পার্থিবজীবনে যখন যা করার নিয়ম বা বিধি রয়েছে তা সঠিক সময়ে পালন করার নামই নিয়মানুবর্তিতা । পৃথিবীর সর্বত্রই নিয়মের রাজত্ব। প্রকৃতির কোথাও অনিয়ম নেই। জীবনের প্রতিক্ষেত্রেই নিয়মানুবর্তিতা লক্ষ করা যায় । রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিদেবী বলেছেন- 'প্রকৃতির রাজ্যে অনিয়মের অস্তিত্ব নাই; সর্বত্রই শৃঙ্খলা। আকাশের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র-সবকিছু একটা নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তিত হচ্ছে । যথানিয়মে আকাশে সূর্য ওঠে, চাঁদ হাসে ।
শীত, গ্রীষ্ম,
বর্ষা, শরৎ যথানিয়মে আসে । নদ-নদী,
পশু-পাখি, বৃক্ষরাজি- সকলের মধ্যেই নিয়মের পালা চলছে । প্রাণিজগতেও এ
নিয়ম বিরাজমান। পাখিরা সকালে জেগে কলগান করে, রাতে বিশ্রাম নেয়। মৌমাছি, পিপীলিকা প্রভৃতি ক্ষুদ্র প্রাণীদের মাঝেও নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায় না । সৌরজগতের
সামান্যতম ব্যতিক্রমের অর্থই হলো অনিবার্য মহাপ্রলয়, সৃষ্টির অন্তিম প্রহর ঘোষণা ।
শৃঙ্খলাবোধ কী :
শৃঙ্খলাবোধ বলতে জীবনযাপনে নিয়মনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি আনুগত্যকে বোঝায়। অর্থাৎ সুনিয়ন্ত্রিত, সচেতনতা, সংজীবনাদর্শের রীতিনীতিকে বলে শৃঙ্খলাবোধ। কোনো মানুষই তার খেয়ালখুশিমতো চলতে পারে না । গভীর জীবনপ্রত্যয়, অধ্যবসায় আর সুনিয়ন্ত্রিত সাধনার মাধ্যমে মানুষ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় এবং মানবিক কল্যাণ ও আদর্শের প্রতি যথাযথ অনুগত থেকে জীবনপরিচালনার এই মানবিক প্রত্যয়ই হলো শৃঙ্খলাবোধ । সমাজে রাষ্ট্রে এবং ব্যক্তিজীবনে এই শৃঙ্খলাবোধ যত দৃঢ় হবে মানসিক সমৃদ্ধি ততই উন্নত হবে, অটুট হবে ।
শৃঙ্খলাবোধের প্রয়োজনীয়তা :
মহান
দার্শনিক রুশো বলেছেন, মুক্তভাবে জন্মগ্রহণ করলেও প্রতিপদেই সে শৃঙ্খলিত ।
জীবনের সর্বস্তরেই নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজন রয়েছে । পরিবারের সদস্যদের
মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা না থাকলে পরিবারে
বিশৃঙ্খলতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদাল, খেলার মাঠ, কল-কারখানা, হোটেল
ইত্যাদিতে নিয়মানুবর্তিতার অভাবে দেখা দেওয়া চরম নৈরাজ্য । আমাদের স্তব্ধ
করে দিতে পারে বিশৃঙ্খল৷ । খেলার মাঠে
ও যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রয়োজন গভীরভাবে অনুভূত হয়ে থাকে।
যে টিম ও যে সৈন্যদল শৃঙ্খলা রক্ষা করে না তাদের পরাজয় অনিবার্য। বস্তুত শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে যথাসময়ে সঠিক মান অক্ষুণ্ণ রেখে সম্পন্ন করা যায় না । নিয়ম-শৃঙ্খলা না থাকলে বর্তমান সমাজ ও সভ্যতা গড়ে উঠতো না । তাই জীবনে নিয়ামনুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম । এ জন্যে বলা হয়, 'নিয়মানুবর্তিতাই উন্নতির চাবিকাঠি।'
সুশৃঙ্খলজীবনে প্রতিটি মুহূর্তের সদ্ব্যবহার হয়। মহান ব্যক্তিদের জীবনে তা দেখা যায়
। চিন্তা ও কর্মে শৃঙ্খলা
অনুসরণ করলে মানুষ মহৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে । দায়িত্বের প্রতি
সৎ ও একাগ্র থাকাটাও
শৃঙ্খলার এক মৌলিক অংশ
। নাগরিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্যে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও অপরিহার্য ।
শৃঙ্খলাবোধ সৃষ্টি ও অর্জনের উপায় :
সকল শিক্ষার সূতিকাগার হচ্ছে পরিবার। পারিবারিক সুশৃঙ্খল পরিবেশ-প্রতিবেশের মধ্যে শিশুকে বড় করে তুলতে হবে। ন্যায়-নিষ্টা, অধ্যবসায়, সত্যবাদিতা, স্বাস্থ্যসচেতনতা, জ্ঞানানুরাগ এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতির মধ্যে শিশুকে বড় করে তুলতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুর শৃঙ্খলাবোধ জাগিয়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে । অপরপক্ষে, শৃঙ্খলাবোধ আত্মস্থ করার জন্য অবশ্যই কতিপয় রীতিনীতি অনুসরণ করা জরুরি। প্রথমত, প্রয়োজন সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলা ।
দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। মর্যাদা অনুসারে মানুষের সঙ্গে শ্রদ্ধা, প্রীতি ও স্নেহের সম্পর্ক অনুসরণ করতে শেখা সামাজিক শৃঙ্খলার প্রাথমিক পদক্ষেপ । শৃঙ্খলাবোধ অর্জনের ক্ষেত্রে উত্তম নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের অনুশীলন দরকার । জ্ঞান ও চিন্তার প্রসারতাও শৃঙ্খলাবোধ অর্জনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে । ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাবোধ : জগৎ নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা হলো আমাদের সে নিয়ম যেমন মেনে চলতে হয়, তেমনি জীবনকে আয়ত্ত করতে হয় ।
আমাদের নিয়মানুবর্তিতার প্রথম শিক্ষা হচ্ছে মা-বাবার আদেশ-উপদেশ যথাযথভাবে মেনে চলা । তার পরই স্কুলজীবনে শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে আমরা নিয়মানুবর্তিতার পাঠ নিই । এজন্য ছাত্রজীবন নিয়মানুবর্তিতার একটি প্রকৃষ্ট প্ররোগক্ষেত্র এবং উপযুক্ত সময়। সুপরিকল্পিত এবং সুসামঞ্জস্য নিয়মাবলির অধীনে একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিজীবন এবং ছাত্রজীবন পরিচালিত হলে সে জীবনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসতে বাধ্য ।
সমাজে ও জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলাবোধ :
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে চলতে হলে তাকে সমাজের কিছু নিয়ম-কানুন বা বিধি-নিষেধ
অবশ্যই মেনে চলতে হয়। সেসব নিয়ম-কানুন মেনে না চললে সমাজজীবন
হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তাই সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির কথা ভেবেই মানুষকে সামাজিক শৃঙ্খলার অনুসরণ করতে হয় । তাই মানুষের
উন্নতি ও কল্যাণ নিশ্চিত
করার স্বার্থেই অনেক নিয়ম গড়ে তুলছে সমাজ। সামাজিক জীবনের মতো রাষ্ট্রীয় জীবনেও কতকগুলো আইন-কানুন মেনে চলতে হয় । সে সব
আইন মেনে চলার মাঝে জাতীয় জীবনের সমৃদ্ধি নির্ভরশীল । বস্তুত সুশৃঙ্খল
জাতিই নিশ্চিত করতে পারে জাতীয় জীবনে ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি ।
ভাই প্রতিটি ব্যক্তির সুশৃঙ্খল চিন্তা, কর্ম, আচরণের শক্তিতেই জাতি বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে ।
শৃঙ্খলাবোধের ফলাফল :
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা ভালো ফলাফলের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। শৃঙ্খলা যেন মানুষের জীবনে চলার ছন্দ । সে ছন্দ ব্যক্তিজীবনকে শান্ত, সুস্থির, ফলপ্রসূ করার অবলম্বন। তা যেন সমাজ ও জাতীয় জীবনে অগ্রগতি নিশ্চিত করার চালিকাশক্তি । সেনাবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা অত্যন্ত কঠিনভাবে পালন করা হয়। সে-জন্যে তারা এত কর্মট, বলিষ্ঠ ও কতর্ব্যপরায়ণ। নিয়মিত কাজ করলে অত্যন্ত কঠিন কাজও সহজ হয়ে পড়ে। বিশ্বের মনীষীরাও জীবনে কঠোরভাবে নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলন করে গেছেন। তাদের সাফল্যের মূলে ছিল শৃঙ্খলাবোধ। তেমনি 'বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে লক্ষ করা যায় সুশৃঙ্খল নিয়মই তাদের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
শৃঙ্খলাবোধ ভঙ্গের পরিণতি :
নিয়ম-ভঙ্গের পরিণতি কখনো ভালো হয় না। ব্যক্তিজীবনে, সমাজজীবনে কিংবা জাতীয় জীবনে যে কোনো নিয়মের হেরফের হলে অনিবার্যভাবে নেমে আসে বিপর্যয়। নিয়মানুবর্তিতা-ভঙ্গের ফলাফল যে অনিবার্য বিপর্যয়- তার বহু নজির ইতিহাসে রয়েছে। ইতিহাসের নজির হিসেবে বলা যেতে পারে, হযরত মুহম্মদ (স) -এর নির্দেশ অমান্য করে। মুসলিম বাহিনী 'ওহুদের যুদ্ধে বিশৃঙ্খলভাবে শত্রুর ওপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। নিয়মানুবর্তিতার অভাবে অনেক প্রতিভাবান মানুষকেও জীবনে ব্যর্থতার গ্লানিকে বরণ করতে হয়েছে। মূল কথা হচ্ছে, সার্থক জীবনের জন্যে নিয়মানুবর্তিতার বিকল্প নেই ।
প্রকৃতিতে শৃঙ্খলবোধ :
মানুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঠশালা হলো প্রকৃতি। প্রকৃতি থেকেই আমরা জীবনের শৃঙ্খলার শিক্ষা। গ্রহণ করতে পারি। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সম্পর্ক তাতেও রয়েছে নিয়ম, যা ভঙ্গ করলে তার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে, তা গ্রিনহাউস ইফেক্ট, ওজোনস্তরের ক্ষয়, পরিবেশ ধ্বংস, বন উজাড়, অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি, ভূমিধস, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি বিপর্যয়ের দিকে তাকালে সহজেই অনুমান করা যায় ।
উপসংহার :
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে জাতি বেশি নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন সে জাতি তত বেশি উন্নত । তাই ব্যক্তি তথা জাতীয় জীবনে উন্নতির জন্যে সর্বস্তরে কঠোরভাবে নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলন করা বাঞ্ছনীয়। এই নিয়মানুবর্তিতাই জাতির অগ্রগতি, জাতির জাগ্রত চেতনা, জাতির উন্নয়ন আর সার্বিক অগ্রগতির ভিত্তি ।