ষড়ঋতুর বাংলাদেশ বাংলা প্রবন্ধ রচনা ২০২৩ - written by Composition.

বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা ২০২৩ 

ষড়ঋতুর বাংলাদেশ বাংলা প্রবন্ধ রচনা 2023 - written by Composition.
 বাংলাদেশ ঋতুচক্র বাংলা প্রবন্ধ রচনা 2023

আরো পড়ুন :- 

আধুনিক জীবনে কম্পিউটার গুরুত্ব প্রবন্ধ রচনা 2023



ভূমিকা :

বাংলার প্রকৃতিতে রূপ, রস, গন্ধ অবিরত রং বদলায়। ঋতুবৈচিত্র্যে বাংলার প্রকৃতি সাজে নানান সাজে। অফুরন্ত রূপ সর্বদা নব নব সাজে সজ্জিত হয় সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ বৈচিত্র্যময় দেশ কখনো ভৈরবী রূপ নেয়, কখনো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, কখনো সজল কালো চোখ তুলে ভালোবাসার বান ছুঁড়ে দেয় প্রকৃতির সন্তানদের দিকে। কখনো কিশোরী মেয়ের মতো বাঁকা চায়, কখনো যৌবন রসে সিক্ত করে সবাইকে। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার অফুরন্ত রূপ কখনো ফুরিয়ে যায় না।

রুদ্র গ্রীষ্ম :

ঋতুরঙের প্রথম কুশীলব গ্রীষ্ম। ধু ধু রুক্ষ দুই চোখে প্রখর বহ্নিজ্বালা নিয়ে তার আবির্ভাব। সূর্যের প্রচন্ড শাসনে ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে। আদিগন্ত মরুজ্বালার মধ্যে গ্রীষ্ম সন্ধ্যা যেন একটি শ্যামল স্নিগ্ধ মরূদ্যান। কালবোশেখির রুদ্রসুন্দর মূর্তি আকাশ মাটির দেহের উত্তাপ মুছে নিতে আসে যা জীর্ণ পতায়, তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গ্রীষ্ম নববিধানের দুর্ধর্ম আশ্বাসবাণী ঘোষণা করে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মের ডালি ভরে ওঠে সুরসাল আম, জাম, কাঁঠালের প্রাচুর্যে। গ্রীষ্ম ফুলের ঋতু নয়, ফুল ফোটাবার ভাড়া নেই তার, শুধু ফলের ডালা সাজিয়েই নিঃশব্দে বিদায় নেয় সে।

নবীন বর্ষা :

রূপসী বাংলার বুকে গ্রীষ্মের পর আসে শ্যামল সরস সজল নবীন বর্ষা। গ্রীষ্মের লেলিহান হোমশিখাকে আবৃত করে দূর দিগন্তে ধূসর আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে ওঠে নবীন মেঘের স্তূপ। এক অপূর্ব সমারোহে আকাশ-বাতাস ব্যাপ্ত করে রাজ রাজেশ্বরের মতো আসে বর্ষা। বর্ষমঞ্জের দ্বিতীয় কুশীলব সে। বর্ষা বাংলাদেশের সবচেয়ে জীবন্ত ঋতু। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ বিকাশ গুরুগম্ভীর বজ্রনিনাদের 'অতি ভৈরব হরষে' মধ্যে সূচিত হয় তার শুভাগমন।

তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকু তাঁর 'বর্ষামঙ্গল' কবিতায় বলেছেন

ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে

জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে

ঘন গৌরবে নবযৌবনা বরষা

শ্যামগম্ভীর সরসা । "

বর্ষার আগমনে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যে বিপুল পরিবর্তন আসে, অন্য কোনো ঋতুতে তা দেখা যায় না। পল্লী প্রকৃতিতে বর্ষা নিয়ে আসে যৌবনের উদ্দামতা। অবিশ্রান্ত বর্ষণে মাঠঘাট, খালবিল, নদীনালা ভরে যায়। দূর দিগন্ত থেকে দুরন্ত বায়ু ছুটে আসে হা হা শব্দে। শুরু হয় শীতল ধারাবর্ষণ। বহুদিন পরে আবার শোনা যায় নানা সংগীতে মুখর পাখির কূজন। মাটির কঠিন শাসন ভেদ করে নবীন শস্যশিশুর দল বেরিয়ে পড়ে নবজীবনের জয়যাত্রায়। প্রকৃতির ধূলি বিষণ্ণ অঙ্গ থেকে গ্রীষ্মের ধূসর অবসাদ মুছে গিয়ে ঘনিয়ে আসে সজল বর্ষাপ্রকৃতির পুষ্প বিকাশের পরম লগ্ন। কদম্ব, কেয়া, জুই, গন্ধরাজ, হাস্নাহেনার বিচিত্র বর্ণ গন্ধের উৎসবে বাংলার প্রকৃতির হৃদয়ের দ্বার যেন খুলে যায়।

অমল ধবল শরৎ :

বৈচিত্র্যময় রূপৈশ্বর্যের রানী বাংলার তৃতীয় ঋতু শরৎ। অমল ধবল পালে ছন্দ মধুর হাওয়া লাগিয়ে প্রকৃতিতে আবির্ভাব ঘটে শরতের। কাঁশফুলের শুভ্রতায় প্রকৃতিতে শাস্তির পরশ লাগে। শিউলি ফুলের মন উদাস করা লম্ব মানবমনে ভালোবাসা জাগিয়ে দেয়। ভোরের শিশিরের কোমলতা নিয়ে প্রকৃতি মানবমনে সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়।

শরতের রূপে মুগ্ধ কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন----

"আজি কী তোমার মধুর মুরতি

হেরিনু শারদ প্রভাতে।

শরতে পৃথিবী যেন সদ্যস্নাতা তরুণীর মূর্তি পরিগ্রহ করে দেখা দেয় অপরূপ মহিমায়। তারই বন্দনায় গাছ থেকে শেফালি ঝরে পড়ে। শরতের মূর্তিতে নিহিত রয়েছে একটি পরিতৃপ্তির হাসি। বাঙালি হিন্দু সমাজের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজার আয়োজনে মুখর হয়ে ওঠে বাংলার গ্রাম নগর। তবে শরতের অবসর কম। রাতে তার শেফালি ঝরে যায়, ধানের ক্ষেতে তার সৌন্দর্য পলকে পলকে নতুন হয়, বন-উপবন, দোয়েল কোয়েলের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।

সুমঙ্গলা হেমন্ত :

শরত্রানীর বিদায় বার্তা ঘোষিত হতেই হিমের ঘন ঘোমটায় মুখ ঢেকে হেমন্ত এসে উপস্থিত হয় সে যেন ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। খেতে খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান ওঠতে থাকে। চারদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা। ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্নের উৎসব।

কবি জাহানারা আরজুর ভাষায় --

চারদিকে মউ মউ নবান্নের ঘ্রাণ-

কার্তিকের সোনা ধানে ভরে যায় গোলা,

হেমন্তের দিনগুলো আসে ঝকঝকে

সোনার থালায় "_

হেমন্ত আবহমান বাংলার এক আনন্দময় উৎসবের ঋতু। হেমন্তের জীবন ত্যাগের মহিমায় প্রোজ্জ্বল। ঘরে ঘরে ফসলের সওগাত বিলিয়ে দেওয়ার জন্য যেন তার আগমন অবস্থান। নিজেকে উজাড় করে দেওয়াই যেন তার মহান ব্রত। নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মধ্যেই তার সার্থকতা। নতুন শাক-সবজির পসরা বহন করে আনে মানুষের দুয়ারে। মানুষকে বাঁচাবার উপকরণ হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নেয় হেমন্ত।

হাড় কাঁপানো শীত :

হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জড়াগ্রস্ত শীতের ধূসর বার্ধক্য। শুষ্ক কাঠিন্য, পরিপূর্ণ রিস্ততা দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। বিবর্ণ কানন বীথির পাতায় পাতায় নিঃশেষে ঝরে যাবার নির্মম ডাক এসে পৌঁছায়। এক সীমাহীন রিক্ততায় অসহায় ডালপালাগুলো একদিন হাহাকার করে কেঁদে ওঠে। শীতের আগমনের সাথে সাথে প্রকৃতির ওপর যে শাসন শোষণ শুরু হয়ে যায়, তাতে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে রুক্ষ হয়ে ওঠে।

তাই কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন _

ওগো শীত, ওগো শুভ্র, হে তীব্র নির্মম,

তোমার উত্তর বায়ু দুরন্ত দুর্দম

অরণ্যের বক্ষ হানে। "

নবজীবন বসন্ত :

ঋতুচক্রের সর্বশেষ ঋতু বসন্ত। শীতের ত্যাগের সাধনা তো বসন্তের নবজন্মের প্রতীক্ষায়ই। বসন্ত আসে নবীন প্রাণ, নবীন উৎসাহ, নবীন উদ্দীপনা নিয়ে, যৌবনের সঞ্জীবনী বসে পরিপুষ্ট হয়ে। তার মুখময় স্পর্শে গাছে গাছে জেগে ওঠে কিশলয়। পাখির কলকাকলিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুগীতি পৃথিবীতে সৃষ্টি করে এক অপরূপ মায়া নিকেতন। অশোক পলাশের রঙিন বিহ্বলতায় শিমুল কৃষ্ণচূড়ার বিপুল উল্লাসে, মধুমালতী মাধবী মঞ্জরীর উচ্ছল গন্ধমন্দির প্রগলভতায় সারা আকাশতলে গন্ধ, বর্ণ গানের তুমুল কোলাহলে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি। বসন্তকালে গাছে গাছে নানা ফুল ফোটে। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

উপসংহার:

রূপসী বাংলার এই ঋতুরঙ্গমালা নানা বর্ণ, গন্ধ, গানের সমারোহে নিত্য আবর্তিত হয়ে চলে। ষড়ঋতুর রঙ্গমঞ্চে এমনি করে প্রতিটি ঋতু যুগ যুগ ধরে অভিনয় করে যাচ্ছে। একের পর এক তাদের আগমন অন্তর্ধান বাঙালির প্রাণে রঙ ধরায়। এই ঋতুচক্রের অবদানেই আমাদের বাংলাদেশ হয়েছে সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা এবং অরপাকুন্তলা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url