মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা - By Composition.
মাদকাসক্তি
ও তার প্রতিকার প্রবন্ধ রচনা |
ভূমিকা :
মাদকাসক্তি
আমাদের সমাজের ভয়াবহ একটি সমস্যা। অবশ্য সমস্যা না বলে এক
সংকট বলাই শ্রেয়; কারণ কিছু কিছু পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে একজন মানুষ নিজেকে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে। আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ভিরে এর- ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। একটি জাতির উন্নয়নের ধারাকে গতিশীল করে তরুণ সমাজ। কিন্তু মাদক তরুণ সমাজের সেই অদম্য কর্মপ্রেরণাকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে সে নিজেকে যেমন
ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, তেমনি দেশকেও মহাবিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। এই তরুণরাই তখন
হয়ে ওঠে। দেশের সবচেয়ে বিপথগামী সম্প্রদায়।
মাদকের আদি উৎস :
মাদক
ও এর নেশার ইতিহাস
বেশ প্রাচীন হলেও তার একটা সীমারেখা ছিল। মদ, গাঁজা, আফিম, চরস বা তামাকের কথা
বহু আগে থেকেই মানবসমাজে প্রচলিত ছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বেদনানাশক ওষুধ হিসেবে মাদকের ব্যবহার শুরু হয়- যাকে ইংরেজিতে ড্রাগ বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সৈনিকদের ব্যথার উপশম হিসেবে ড্রাগের ব্যবহার হলেও হতাশা কাটাতেও তারা ড্রাগ ব্যবহার করত। এরপর থেকেই কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর ইত্যাদি দেশে নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যাপকভাবে ড্রাগের ব্যবহার শুর হয় এবং ধীরে ধীরে অ সমগ্র বিশ্বে
ছড়িয়ে পড়ে
মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ :
বর্তমান
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মাদকদ্রব্য
পাওয়া যায়। প্রাচীনকালের মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি আধুনিক সময়ে নানা ধরনের মাদকদ্রব্যের উদ্ভাবন ও ব্যবহার লক্ষ
করা গেছে। হেরোইন, প্যাথেডিন, এলএসডি, মারিজুয়ানা, কোকেন, হাশিশ, প্রভৃতি আধুনিককালের মাদকদ্রব্য; তবে এর মধ্যে হেরোইন
ও কোকেন বেশ দামি। আমাদের দেশের যুব সমাজ সচরাচর যে মাদকদ্রব্যগুলো ব্যবহার
করে সেগুলো হলো- সিডাকসিন, ইনকটিন, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল, ডেক্সপোটেন, গাজা ইত্যাদি। তবে এ সবকিছুর ব্যবহারকে
ছাড়িয়ে গেছে অত্যাধুনিক এক মাদক- “ইয়াবা'।
মাদক চোরাচালান :
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
নানাভাবে মাদক চোরাচালান হয়। সীমান্তে স্থল বা জলপথে এবং
আকাশপথে বিশ্বব্যাপী এক বৃহৎ চোরাচালান
নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে যার পেছনে রয়েছে বিরাট এক সিন্ডিকেট। কিছুকাল
আগেও মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম
নিয়ে গড়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের 'স্বর্ণভূমি' বা 'গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল'। তবে ভিয়েতনামে
সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এই নেটওয়ার্ক ভেঙে
যায়। এর কিছুদিন পরেই
চোরাচালানকারীরা ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নিয়ে
গড়ে তোলে ড্রাগ পাচারের নতুন ভিত্তিভূমি। 'গোল্ডেন ক্রিসেন্ট'।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার :
মানুষ
নিজেকে অপ্রকৃতিস্থ করতে মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে। মাদকের ব্যবহার করে সে কল্পনার এক
জগতে কিছুসময়ের জন্য বিচরণ করে। এক্ষেত্রে মাদক ব্যবহারকারীরা নানা ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে যেমন : ধূমপান, ইনহেল বা শ্বাসের মাধ্যমে,
জিহ্বার নিচে গ্রহণের মাধ্যমে, সরাসরি সেবনের মাধ্যমে, স্কিন পপিং ও মেইন লাইনিং-এর মাধ্যমে। তবে
যেভাবেই গ্রহণ করুক না কেন তাদের
উদ্দেশ্য একটাই— নেশায় উন্মত্ত হওয়া। প্রথমে কৌতূহলের বশে অনেকেই নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে। কিন্তু আস্তে আস্তে তাতে অভ্যস্থ হয়ে ভয়াবহ এক সর্বনাশের পথে
এগিয়ে যায়।
মাদকাসক্তির কারণ :
মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ ব্যক্তিজীবনের হতাশা। মানুষ যখন জীবন সম্পর্কে অনেক বেশি হতাশ হয়ে পড়ে, তখন দে মাদকদ্রব্যের আশ্রয় নেয়। হতাশা সাধারণ তরুণদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়, তাই তাদের মাদক গ্রহণের হারও অনেক বেশি। তাছাড়া অসৎ সঙ্গে লিপ্ত হয়েও অনেকেই মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। যেসব পরিবারে পারিবারিক অশান্তি অনেক বেশি সে পরিবারের ছেলেমেয়েদের জীবন বিশৃঙ্খল হতে থাকে। তারা এই বিশৃঙ্খলা থেকে ধীরে ধীরে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং পরিণামে অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটায়। আমরা এ ধরনের অনেক ঘটনাই লক্ষ করি। বেশির ভাগ ঘটনায় হয় বন্ধু-বান্দব বা সহপাঠী কিংবা পারিবারিক অশান্তিই মূল প্রতিদিনের পত্রপত্রিকায় কারণ হিসেবে দেখা যায়।
বাংলাদেশে মাদকের আগ্রাসন :
আমাদের দেশে
মাদকের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করা এই মাদক আমাদের
যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে অবাধে এ দেশে প্রবেশ করছে ইয়াবা
--- যাতে আক্রান্ত হয়েছে বহু তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতী। দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি
এদেশের একমাত্র লাইসেন্সধারী মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তার বাইরে বহু বিদেশি
কোম্পানির মদ অবৈধভাবে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গাঁজা ও আফিমের মতো মাদকদ্রব্য প্রায়
উন্মুক্ত ভাবে দেশের সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে এবং মাদকসেবীরা তা অবাধে ক্রয়ও করছে।
মাদকাসক্তির ভয়াবহতা :
মাদকের রূপ
অত্যন্ত ভয়াবহ ও আগ্রাসী। একে অনেকটা অপ্রতিরোধ্য রোগ এইডসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে
পারে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির মতোই মাদকাসক্তি মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে
নিয়ে যায়। ইয়াবা ও হেরোইনের মতো মাদকদ্রবা মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে
ধীরে নষ্ট করে দেয়। এর আসক্তিতে মানুষ এক অস্বাভাবিক জীবনযাপন করে। নেশায় আক্রান্ত
ব্যক্তির সুস্থ জীবনে ফিরে আসাও খুব সহজ হয় না। মাদক বন্ধ করা মাত্রই 'উইথড্রয়াল
সিম্পটম' শুরু হয়। তখন মাদক না পেলে শুরু হয় 'টার্কি পিরিয়ড’;
হাত-পা কাঁপতে থাকে; অসম্ভব শারীরিক যন্ত্রণা শুরু হয় এবং একপর্যায়ে তা হৃদপিণ্ডে
আঘাত করে। এই সময় সুচিকিৎসা না পেলে খুব অল্প সময়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে
পারে।
মাদকাসক্তির প্রতিকার :
পারিবারিক,
সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সচেতনতার মাধ্যমে একজন মানুষকে মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখা
সম্ভব। পারিবারিকভাবে একজন নারী বা পুরুষের জীবন যদি সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে তাহলে তার
মাদকের সংস্পর্শে যাওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ক্ষেত্রে ব্যাপক
ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে তারা নানাভাবে মাদকদ্রব্যবিরোধী প্রচারণা
চালাতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মাদকদ্রব্য বিক্রি ও এর সঙ্গে নিয়োজিত চোরাকারবারিদের
বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সার্বিকভাবে একজন মানুষকে যদি তার
নিকটাত্মীয়রা খুব ভালোভাবে পরিচর্যা করে এবং রাষ্ট্র যদি তাকে সুস্থভাবে বাঁচার পরিবেশ
করে দেয় তবে খুব সহজেই মাদকাসক্তির প্রতিকার করা সম্ভব।
উপসংহার :
একটি দেশের গতিশীলতাকে অব্যাহত রাখে তরুণ সমাজ। তারাই যদি মাদকের কবলে পড়ে নিজেদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয় তবে দেশের সার্বিক অগ্রগতি চরমভাবে বিনষ্ট হবে। তাই তরুণ সমাজকে মাদক সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং এর কারবারিদের বয়কট করতে হবে। তাদের ঐক্য ও সুস্থ জীবনের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ মাদকমুক্ত হয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।